আদিবাসী : অপরিচয় ও অধিকার
বাংলাদেশ একটি বহুজাতির, বহুভাষার, বহুসংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠি ছাড়াও ৫৪ টির অধিক আদিবাসী জাতি এখানে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িয়ে আছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্খা। কিন্তু ৩০ জুন ২০১১ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী জাতি সমূহের জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। এমনকি সংবিধানে ৬ (ক) ধারার মাধ্যমে আদিবাসী-বাঙালি নির্বিশেষে দেশের সকল জনগণকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করা হয়েছে। উপরন্তু দেশের দরিদ্র, বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ আদিবাসী জাতিসমূহের সমাজ, সংস্কৃতি তথা জীবধারা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের কোনো উন্নয়ণ নীতিমালা তো নেই বরং উন্নয়ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ণে সিদ্ধান্ত নির্ধারনী কোনো ভূমিকা না থাকায় তাদের জীবনধারা বির্পযস্ত হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিককালে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চনার মাত্রা ও ধরণ অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় আদিবাসীরা নিজ দেশে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। দেশের আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি তাই খুব একটা ভাল নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আদিবাসী নারী ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, লুন্ঠনসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র কখনোই ভূমি কি অরণ্যে, জলাধার কি শস্যদানা, বৃক্ষ কি বসতির সাথে আদিবাসী জনগণের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেয়নি। রাষ্ট্র জবরদস্তি করে নিম্নবর্গের বয়ান ও বুনিয়াদ মুছে ফেলতে চাইছে। কাপ্তাই বাঁধ, ইকো পার্ক, ফুলবাড়ি উন্মুক্ত কয়লখনি, সামজিক বনায়ন, সেটলার অনুপ্রবেশ, বাঙালি বলপ্রয়োগ, জখমের রাজনীতি আর ভূমি ছিনতাই দিন কে দিন বেড়েই চলেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে নামে-বেনামে বহিরাগতদের ভূমি জবরদখলের হিড়িক। নাইক্ষ্যংছড়িতে চাক আদিবাসীরা এবং লামায় ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীরা তাদের অনেক গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর সিলেটে খাসি আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। খাসিদের ভূমি থেকে হাজার হাজার গাছ জোরপূর্বক কেটে নেয়া হয়েছে। কুলাউড়ায় ঝিমাই খাসিপুঞ্জি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। পানপুঞ্জির খাসি ও গারোদের ভূমি সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। খাসি অঞ্চলে নতুন করে সামজিক বনায়নে অংশগ্রহণে আদিবাসীদের চাপ দিচ্ছে বনবিভাগ। অথচ খাসি ও অন্যান্য আদিবাসীদের চিরায়ত প্রথাগত ভূমি মালিকানার কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি।
এই সরকারের আমলেও মধুপুরের বনে মান্দি ও বর্মনদের ভূমি সমস্যা ও শত শত বন মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। বরগুনা ও পটুয়াখালীতে রাখাইনদের জমিজমা নিয়ে সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই। রাখাইনদের পবিত্র সমাধিভূমি ও মন্দির দখল হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী জুম্মদের উপর এক নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলার পর রামুতে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ইপর হামলা সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর, নওগাঁ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, শেরপুর, জামালপুর, নোয়াখালী, হাটহাজারী, সীতাকুন্ড প্রভৃতি স্থানে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের উপর হামলা সংগঠিত হয়েছে। নওগাঁয় এক হামলায় চার জন আদিবাসী শ্রমিককে হত্যা করা হয়।
একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেও জয়পুরহাটে বার কাউন্সিলের কতিপয় আইনজীবীর হাতে আদিবাসীদের বর্ণভেদ প্রথার শিকার হতে হয়েছে। এ সরকারের আমলে আদিবাসী নারীর উপর হামলা ও সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৫ জুলাই ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং ইউনিয়নে ১৫ বছরের এক আদিবাসী কিশোরী এক সেটলার বাঙালি কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের অনেক আদিবাসী দেশান্তরিত হয়েছে। আদিবাসী নারী নেত্রী পর্যন্ত ধর্ষিত হয়েছে। দিনাজপুরের আদিবাসী পল্লী ও একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালানো হয়েছে।আবার ওখানে শ্রীরামপাড়ায় চারজনকে গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে,পরবর্তীতে একজনকে একই স্থানে খুনও করা হয়েছে ।
ধারাবহিক দুঃখ-দুর্দশা, অত্যাচার-অবিচার, লুট-তরাজ, খুন-ধর্ষণ- অপহরণের সর্বশেষ খবর হলো পাহাড় কাঁদছে, অঘোরে-বেঘোরে। মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়নের পাহাড়ি আদিবাসী জনগণ গত বছর আগস্ট মাসেই দীর্ঘদিনের নিজ বসতভিটা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত-কাঁটাতার পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশে আদিবাসীদের কান্না গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে এখন ঝড়ের আশংকা-১০ নম্বর বিপদ সংকেত!
জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের কাজে জন অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার আদিবাসীরা সুবিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। এমতাবস্থায় অসাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং প্রগতিশীল দেশগঠনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার চিত্র জাতীয় পর্যায়ে উপস্থাপন করে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিদ্যামান বিভিন্ন সমস্যা ও বৈষম্য বিষয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে আদিবাসী ইস্যুতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও আদিবাসী যুব কণ্ঠস্বর শক্তিশালী করণ এবং মানবাধিকার কর্মীদের দৃষ্টি আরও প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে,প্রত্যাশা এই সরকারও এ বিষয়ে আরও সচেতন পদক্ষেপ নেবেন ।
অতএব, নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আলোচিত এবং বিবেচিত হওয়ার প্রত্যাশা করছি।
আদিবাসী আমরা বলছি ঠিক, কিন্তু রাষ্ট্র তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয় নি। যদিও বাংলাদেশে উপজাতি, কিংবা আদিবাসী শব্দটি অনেক সময় একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সরকারী ভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী, তফশিলী সম্প্রদায় ইত্যদি শব্দগুলো ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজশাহী-রাঙ্গামটি-খাগড়াছড়ি-নেত্রকোণাতে আদিবাসীদের জন্য যেসব সাংস্কৃতিক একাডেমি করা হয়েছে সেসবের নাম যে কতবার পরিবর্তিত হয়েছে তা স্থানীয় ‘সাইনবোর্ড লিখিয়েরা’ বেশ ভালো হিসাব দিতে পারবে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস বলছি ঠিক কিন্তু রাষ্ট্র সেটি পালন করে না। বাংলাদেশের আদিবাসীরা নাম পরিচয়হীন অর্থাৎ তাদের সংকট রাষ্ট্রীয়ভাবে সৃষ্ট-আত্মপরিচয়ের সংকট। কাজেই দীর্ঘদিন বসত করার পরও নিজের মাটির উপর তার অধিকার রাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে খর্ব করে, করার চেষ্টা করে। মুখের কথায় চোখের দেখায় যারা জুম চায় করে, কাগজের প্রমাণ তারা কোথায় পাবে? এইজন্য সরকার পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেই ভূমি কমিশন আইন করার কথা বলেছিল কিন্তু সেখানেও চলছে নানা অসঙ্গতি। আইনটি যথাযথ ও যুক্তিযুক্তভাবে প্রণয়ন হলে ভূমি সমস্যার একটা বিরাট সমাধান হত। আদিবাসীরা তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেত, বাঙালিরাও তার নিজস্ব সীমানা বুঝে নিত। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার আদিবাসী জনগণের জন্য নানা ঘোষণা ও অঙ্গীকার করেছিল। যার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
সকল প্রতিকূলতা সত্বেও বাংলাদেশে আদিবাসী জনগণ দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে সাথে নিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তাই মনে রাখতে হবে, আমরা সকলেই এই এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার প্রেমকাঠি ও অনুঘটক কিন্তু !
রাজীব মীর
শিক্ষক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
রবি/প্রতিক্ষণ/এডি/রাকিব